মোঃ আতিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ থেকে: ছাতকে আলোচিত স্কুল ছাত্রী ইজা বেগম ইভা হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ইভার আপন ভাই রবিউল হাসান( ২০)। গ্রেফতারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে খুন করার কথা স্বীকার করে লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের বর্ণনা দেয় ইভার আপন ভাই রবিউল হাসান।
উল্লেখ্য, বুধবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে সামান্য দূরবর্তী একটি দোকান থেকে মোবাইলের এমবি কার্ড কিনতে গিয়ে নিখোঁজ হয় ইজা বেগম ইভা। নিখোঁজের কয়েক ঘন্টা পর গ্রামের রাস্তার পাশে ধান ক্ষেতে ইভার মাথা-বিহীন লাশ দেখতে পায় গ্রামবাসী। পরে স্থানীয় লোকজন থানায় খবর দিলে রাতেই ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত ইভা দক্ষিণ কূর্শী গ্রামের মোশাহিদ আলীর কন্যা ও দক্ষিণ কূর্শী পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। এ ঘটনায় শনিবার নিহত ইভার পিতা মোশাহিদ আলী বাদী হয়ে ছাতক থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নাবালক বোনের হত্যাকারী রবিউল হাসান উপজেলার দোলারবাজার ইউনিয়নের দক্ষিণ কূর্শী গ্রামের খালেদ হত্যা মামলার অন্যতম আসামী। একই মামলার অপর দুই আসামী দক্ষিণ কূর্শী গ্রামের লিকসন ওরফে আক্কেল মিয়া ও হোসেন আলী দীর্ঘদিন একই সাথে হাজতে ছিলো। সম্প্রতি উচ্চ আদালতের আদেশে জামিনে মুক্ত হয়ে খালেদ হত্যা মামলার বাদী আহমেদ আলী ও তার পরিবারকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করে তারা। তাদের ধারণা ছিলো অপর একটি হত্যা মামলায় বাদীকে ফাঁসিয়ে দিতে পারলে উভয় মামলা আপোষে নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রবিউল হাসানের দু’বোনের মধ্যে যে কোন একজনকে খুন করার পরিকল্পনা করে তারা। তাদের এই নির্মম পরিকল্পনার শিকার হয় ইজা বেগম ইভা। ঘটনার দিন বিকেল থেকেই হত্যার বিভিন্ন ছক তৈরি করতে থাকে রবিউল ও তার সহযোগীরা। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে মোবাইলের এমবি কার্ড আনার জন্য ২০ টাকা ও আইসক্রিম খাওয়ার জন্য আরও ১০ টাকা দিয়ে বোন ইভাকে গ্রামের একটি দোকানে পাঠায় রবিউল। সেখানে রাস্তার পাশে একটি সিএনজি নিয়ে আগে থেকেই ওৎ পেতে থাকা তার সহযোগীরা ঝাপটে ধরে ইভাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। পরে কূর্শী-সিরাজগঞ্জ রাস্তার পাশে নিয়ে একটি পলিথিনের উপর ফেলে ইভার মুখে কাপড় ঢুকিয়ে দেয় ঘাতকরা। সঙ্গী দুজন ইভার তার হাতপা শক্ত করে ধরে রাখে এবং পাষন্ড ভাই রবিউল রামদা দিয়ে পর পর দুটি কুপ দেয়। এতে ইভার দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়। পরে রবিউলের নির্দেশে তার সহযোগীরা ইভার মাথা বিহীন নিথর দেহে উপর্যপরি ছুরিকাঘাত করতে বাধ্য হয়। পরে রাস্তার পাশের একটি ডুবন্ত জমিতে মাথা এবং রাস্তা সংলগ্ন জমিতে ইভার লাশ ফেলে চলে যায় খুনিরা। বোনকে খুন করে ঠান্ডা মাথার খুনি রবিউল বাড়িতে এসে স্বাভাবিকভাবে পরিবারের লোকজনদের সাথে বোন ইভাকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। তার আচরণ এমন ছিলো যে কোনভাবে তাকে কেউই সন্দেহের চোখে দেখার সুযোগ ছিল না। কিন্তু তার এ নাটকীয় আচরণ দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তার চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। অবশেষে বোনকে খুনের দায়ে তাকে হাতকড়া পড়তে হয়।
সুনামগঞ্জের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (ছাতক সার্কেল) রনজয় চন্দ্র মল্লিক জানান, হত্যাকান্ড নিয়ে ইভার পরিবারের সাথে একাধিকবার কথা বলেন তিনি। তাদের মধ্যে রবিউলের কথাবার্তা ছিলো অনেকটাই অসঙ্গতিপূর্ণ। এ সময় তিনি এ হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন ও খুনিদের সনাক্ত করতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। ইভার বাড়িতে নিয়মিত পুলিশ প্রহরা দিয়ে পরিবারের লোকজনের উপর নজর রাখতে নির্দেশ দেন তিনি। তার কৌশল ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই আলোর মুখ দেখে।
তিনি জানান, শুক্রবার মামলা দায়েরের কথা বলে ইভার মা-বাবা ও ভাই রবিউলকে থানায় নিয়ে আসেন। রাত থেকেই তাদের পৃথক পৃথক জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে শনিবার শিশু ইভা বেগমকে হত্যার কথা স্বীকার করে আসামি রবিউল হাসান। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বোন ইভাকে খুন করেছে বলে জানায় সে। এ সময় ইভা খুনের লোমহর্ষক কাহিনীর বর্ণনা দেয় সে। পরে রবিউল হাসানের দেওয়া তথ্যমতে ইভা বেগমের মাথা ক্ষেতের জমি থেকে উদ্ধার করা হয়। আজ সোমবার বিজ্ঞ আদালতেও ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে সে। পরে আদালতের মাধ্যমে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। তার সহযোগী অন্যান্য খুনিদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রহস্য উদঘাটন ও খুনিদের সনাক্ত করতে থানার ওসি (তদন্ত) সহ পুলিশ কর্মকর্তাগণ তার সাথে ছিলেন বলে জানিয়েছেন এএসপি রনজয় চন্দ্র মল্লিক।